অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত পার্ট-২
- 15-Apr-2022 01:23AM
- Zahidul Islam
- 3662
বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বঃ
পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম । পরিবহন এবং যোগাযোগ একে অপরের পরিপূরক । নি¤েœ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা করা হলো ঃÑ
উৎপাদন বৃদ্ধিঃ
যে কোন দেশের জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির উন্নতির ধারা বজায় রাখতে হলে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য । স্থির মূল্যে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে দেশজ উৎপাদনে ’পরিবহন ও যোগাযোগ’ খাত (স্থলপথ পরিবহন, নৌ-পরিবহন, বিমান পরিবহন, সহযোগী পরিবহন সেবা ও সংরক্ষণ এবং ডাক ও তার যোগাযোগ উপখাত সমন্নয়ে গঠিত ) অবদান ও প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১০.৯১% ও ৭.৬৯% দেশজ উৎপাদনে ২০১০-১১ অর্থবছরে এ খাতের অবদান ১০.৯১% এবং ৭.৯৩% । সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ।
(বি বি এস সাময়িক হিসাব ) ।
উপকরন ও পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাত করনঃ
উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে বাজার ব্যবস্থা সুসংগঠিত হয় । উৎপাদনের উপকরন পণ্যের বাজারজাতকরনে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য । পণ্য ও উপকরনের ন্যয্য দাম, গুণাগুণ, উপকরনের গতিশীলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কাজে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এজন্যই পরিবহন ও যোগাযোগের এত গুরুত্ব প্রদান করা হয় ।
দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষাঃ
উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে খুব সহজে এবং দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করা যায় এবং বিভিন্ন স্থানে পণ্যের চাহিদা, যোগান ও মূল্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মূল্যস্থরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। ফলে অর্থনৈতিক বাজারের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয় । উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পের উপকরন বিশেষ করে শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায় । ফলে দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা সহজ হয় এবং বেকার সমস্যার সমাধান হয় । উপকরনের গতিশীলতা না থাকলে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । সুতরাং দেশকে বেকার মুক্ত করতে হলে পরিবহন ও যোগাযোগের দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিতে হবে । তাহলে বুঝতে পারি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও উপকরনের গতিশীতার সাথে পরিবহন ও যোগাযোগের গভীর সম্পর্ক রয়েছে ।
শিল্প ও কৃষির উন্নয়ন ঃ
দেশের শিল্প ও কৃষি খাতের যুগোপযোগী উন্নয়ন সাধন করতে হলে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আবশ্যক । কৃষি ও শিল্পের উপকরন সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য বাজার জাত করনে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম । দেশের আয়তন কম হওয়ায় কৃষি কাজের জমির পরিমান কম হওয়ায় উৎপাদনও কম হয় । তবে শহরে আজকাল কিছু কিছু শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠতে দেখা যাচ্ছে ।
উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পের উপকরন বিশেষ করে শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায় । ফলে দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা সহজ হয় এবং বেকার সমস্যার সমাধান হয় । উপকরনের গতিশীলতা না থাকলে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । সুতরাং দেশকে বেকার মুক্ত করতে হলে পরিবহন ও যোগাযোগের দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিতে হবে । তাহলে বুঝতে পারি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও উপকরনের গতিশীতার সাথে পরিবহন ও যোগাযোগের গভীর সম্পর্ক রয়েছে ।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি বৃদ্ধি ঃ
উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্য, সেবা ও উপকরন খুব সহজ এবং দ্রুত সময়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে বহন করা যায় । এর মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে প্রেরণ করা যায় । এজন্য পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প কোন কিছু নাই । তাই বলা যায় উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগের এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি বৃদ্ধি পায় ।
জরুরী অবস্থা মোকাবিলা ঃ
দেশের কোন অঞ্চলে বন্যা, মহামারি, ঝড়, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দেখা দিলে দ্রুত অঞ্চলের বিস্তারিত তথ্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগ্রহ ও পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরন ও উদ্ধার কাজ সহজে করা যায় । অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাবে সঠিক ভাবে জরুরী অবস্থার মোকাবিলা করা সম্ভবঃপর হয় না । সুতরাং সহজ ও সুবিধা জনক পরিবহন ও যোগাযোগের থাকলে দেশের যে কোন সমস্যায় জরুরী আবস্থা মোকাবিলা করা সহজ হয় ।
সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ঃ
উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব । আমাদের দেশে সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না । যার ফলে অনেক সময় কাঙ্খিক লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না । পরিবহন ও যোগাযোগের সহজ ও স্বলখরচে পরিচালিত হলে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব হয় । এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে থাকে ।
বিনিয়োগ বৃদ্ধিঃ
বর্তমানে বাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের যুগে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও দেশি বিনিয়োগ খুবই গুরুত্ব পুর্ণ । আর এই বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই । আমাদের দেশে যোাগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেক সময় বিদেশি বিনিয়োগ কম হয় । তাই দেশে বিনিয়োগের পরিমান বাড়াতে চাইলে পরিবহন ও যোগাযোগের উপর গুরুত্ব দিতে হবে । বিনিয়োগ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সমৃদ্ধি আসবে না ।তাই উন্নত পরিবহন ও আধুনিক যোগাযোগ ছাড়া দেশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না ।
গ্রাম ও শহরের বৈষম্যঃ
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত হয় পৃথিবী তত ছোট ও সংকীর্ণ হয় । আমাদের দেশে শহরের তুলনায় গ্রামের পরিবহন ব্যবস্থা খুবই খারাপ । ফলে আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের মধ্যকার পরিবহন ও যোগাযোগ বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে । যদি সুষ্ঠ ভাবে গ্রামের সাথে পরিবহন ও যোগাযোগের ব্যবস্থা করা যায় তবে গ্রামের লোকজন শহরে গিয়ে প্রতিদিন কাজ করে বাড়ি আসতে পারবে । এতে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার বৈষম্য দূরীভূত হবে । আমাদের দেশে গ্রামের শ্রমের মজুরি কম কিন্তু শহরে শ্রমের মজুরি বেশি । যদি গ্রামের লোকদের কাছে পরিবহন ও যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা করতে পারলে তারা বিভিন্ন স্থানে কাজ করে গ্রামের ফিরে আসবে । ফলে গ্রামে উন্নতি হতে থাকবে । ধীরে ধীরে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার দূরত্ব কমে আসবে ।
অভ্যান্তরীন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি ঃ
বিভিন্ন দেশের সাথে দেশের অভ্যান্তরে ব্যবসায় বাণিজ্যর গতি বৃদ্ধিতে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে । দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব । আমাদের দেশে যে পরিমান দ্রব্য সামগ্রি উৎপাদন হয় তার চাইতে বেশি দ্রব্য সামগ্রি আমদানি করতে হয় । বিভিন্ন দেশের সাথে আমাদের প্রচুর পরিমানে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে । তবে আমাদের তৈরী পোশাক, চামড়া,মৎস্য,কুটির শিল্পের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে । তাই পরিবহন ও যোগাযোগের উন্নতি সাধন করে আমরা বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে পারি ।
সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনঃ
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সহজে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় সম্পদের সুষ্ঠ বন্টন করা হয় না । অনেক ক্ষেত্রে দুনীতি করা হয় । তাই সবক্ষেত্রে সমান ভাবে উন্নয়ন পরিলক্ষত হয় না । সরকারি পরিবহন জনগন কর্তৃক ব্যবহ্রত হয় । রাস্তা ঘাট সরকার কর্তৃক নির্মিত হয় । তাই বলা যায় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগনের উন্নয়ন সাধিত হয় । তার ফলে অর্থনীতির উন্নতি সাধিত হয় । এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক । আমাদের দেশে অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে দেশের ভিতরে বিশৃংখলা দেখা দেয়। যা কিনা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধার সন্মুখীন হয় । যানজটের কারনে রাস্তাঘাটে বিশৃংখলা দেখা দেয় । চাহিদা মোতাবেক পরিবহন ও যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলে এই সমস্ত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয় ।
বাংলাদেশেরঅর্থনৈতিক উন্নয়নে আমার সুপারিশঃ
আমরা জানি বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ দরিদ্র সীমার মধ্যে বসবাস করে । আবার জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীতে আমদের অবস্থান সপ্তম । সুতরাং আমাদের বিভিন্ন কাজের জন্য অধিক পরিবহন ও যোগাযোগের প্রয়োজন পড়ে । আমাদের দেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি কৃষি ও শিল্প ভিত্তিক । ফলে সর্বদা গ্রামের সাথে শহরের যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয় । যা সম্ভব হয় পরিবহন ও যোগাযোগের মাধ্যমে । কিন্তু আমাদের দেশের প্রয়োজনের তুলনায় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই সীমিত এবং বিংশ-শতাব্দীর প্রযুক্তির সাথে মানানসই নয় । তবে নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট, সেতু নির্মান করে । নতুন নতুন আধুনিক যানবাহন যুক্ত করে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব ।
নি¤েœ একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি তুলে ধরা হলোঃ
নাটোর শহর থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব ২০১ কিলোমিটার । বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মানের পূর্বে নাটোর শহর থেকে ঢাকায় যেতে সময় লাগত ৭০-৭২ ঘন্টা । কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু সেতু সংযুক্ত হওয়ার ফলে মাত্র ৪ থেকে ৫ ঘন্টার মধ্যে নাটোর থেকে ঢাকায় পৌছা সম্ভব হচ্ছে । আবার পুর্বে ডাকযোগে চিঠি আদান করতে ৩থেকে ৫ দিন সময় লাগত । কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মিনিটের মধ্যে বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করতে পারি ।
পরিশেষে বলা যায় যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে । উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের আরও আধুনিক ও শক্তিশালী পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে হবে । এজন্য সরকারি এবং বেসরকারী ভাবে বিভিন্ন উদ্দ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে । তাহলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও তরান্বিত হবে ।