খাদ্য সমস্যা-পার্ট-২
- 27-Mar-2022 03:21AM
- Zahidul Islam
- 1033
৫ম অধ্যায়
বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যার কারণঃ
বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যা বিষয়টি ব্যাপক ও সর্বপেক্ষা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে ।
যেখানে ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ।
বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যার কারণ আলোচনা করা হলো ঃ
১.ভূমির উর্বরতা হ্রাসঃ
ক্রমাগত চাষের ফলে আমাদের জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে । একক প্রতি জমির ফলন আমাদের দেশে খুবই কম ।
সুতরাং প্রয়োজন অনুসারে দেশে খাদ্য উৎপাদনের পরিমান বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না ।
২. জনসংখ্যার চাপঃ
আমাদের দেশে জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে । ২০১০ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৯৬ জন মানুষ বাস করত । ফলে খাদ্য সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে ।
৩. চোরাচালানঃ
প্রতি বছর বিপুল পরিমান খাদ্যশস্য চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্তে চলে যায় । এটি একদিকে যেমন খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় তেমনি বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনও কমিয়ে দেয় ।
৪. জমির ফলন কম ঃ
অন্যান্য উন্নত দেশের তুলায় আমাদের দেশের
জমির ফলন কম হয় । জমির স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যার অন্যতম কারন হিসেবে বিবেচিত করা হয় ।
৫.ভাল বীজ ও ভাল সারের অভাবঃ
বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষক জমিতে ভাল বীজ ও ভাল সার দিতে পারে না । ফলে জমির একর প্রতি উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম ।
৬.খাদ্য সংরক্ষণের অভাবঃ
আমাদের দেশে খাদ্য গুদামের একান্ত অভাব রয়েছে । ফলে ফসলের মৌসুমে আমরা পর্যাপ্ত পরিমানে খাদ্য গুদামজাত
করতে পারি না । সংরক্ষণের অভাবেও অনেক খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যায় ।
৭. মূলধনের স্বল্পতাঃ
আমাদের কৃষিতে মূলধনের অভাব রয়েছে । এ দেশের দরিদ্র কৃষকের পক্ষে কৃষিতে পর্যাপ্ত মূলধনের যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না । ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয় ।
৮. কৃষি ঋণঃ
বাংলাদেশে কৃষি ঋণের যোগানও পর্যাপ্ত নয় । সরকার, কৃষি ব্যাংক, ও অন্যান্য ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে
কৃষক যে ঋণ পায় তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম ।
৯. পরিবহন ব্যবস্থাঃ
আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত । পরিবহন ব্যবস্থার অসুবিধার ফলে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খাদ্য শস্য চালান দেওয়া যায় না । এতে অনেক সময় খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয় ।
১০. পুরাতন চাষাবাদ পদ্ধতিঃ
বাংলাদেশে এখনো মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয় । ফলে জমির ফলন খুবই কম ।
১১. নৈসর্গিক বিপর্যয়ঃ
বন্যা ও ঝড়ে আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ শস্যের ক্ষতি হয় । বন্যার করা গ্রাসের বিরুদ্ধে কোনরূপ কার্যক্রর ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন বিধায় আমাদের দেশে এটি প্রায় নিয়ন্ত্রের বাইরে । ফলে খাদ্যাভাব দেখা দেয় ।
১২. ত্রুটিপূর্ণ ভুমি স্বত্ব ব্যবস্থাঃ
এ দেশের প্রায় ৫০ ভাগ কৃষক মূলত ভূমিহীন । তারা অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে । ত্রুটিপূর্ণ ভুমি স্বত্ব ব্যবস্থার কারণে এই অবস্থা পরিলক্ষিত হয় ।
১৩. অর্থকারী ফসলঃ
নগত অথ পাবার লোভে কৃষকেরা ধানের জমিতে পাট,তামাকের চাষ করে । এর ফলে খাদ্য সমস্যা হ্রাস পায় ।
১৪. অনাবাদী জমিঃ
বাংলাদেশে অনেক অনাবাদী জমি রয়েছে । বাংলাদেশ পরিসংখ্যানব্যুরোর তথ্য মতে জানা যায়
বাংলাদেশে প্রায় ২.৩৫ লক্ষ হেক্টর জমি পতিত রয়েছে । এটিও খাদ্য সমস্যার জন্য বহুলাংশে দায়ী ।
৬ষ্ঠ অধ্যায়
বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা প্রতিকারের উপায়ঃ
বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যার প্রতিকারের উপায় হিসেবে নি¤েœাক্ত ব্যবস্থা গুলো গ্রহণ করা যেতে পারে ।
১. আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধিঃ
বাংলাদেশে এখনো প্রায় ২.৩৫ লক্ষ হেক্টর অনাবাদি জমি আছে । সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং জলাবদ্ধতা ও লবণাক্তা
দূরী করণ এর মাধ্যমে এসব জমিকে চাষের অধীনে আনা যায় । এত দেশের খাদ্য শস্যর উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব ।
২.অবিরাম চাষ পদ্ধতির প্রবর্তনঃ
অবিরাম চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে একাধিক ফসল ফলানোর পরিকল্পনা কার্যক্রর করতে পারলে দেশে খাদ্য শস্যর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে । এ পদ্ধতিতে একই জমিতে বছরে ৩-৪ ধরণের ফসল উৎপাদন করা যায় ।
৩.কীটপতঙ্গের আক্রমণ রোধঃ
ফসলকে পোকামাকরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারলে আমাদের উৎপাদনের পরিমাণ উল্ল্যেখ যোগ্য বৃদ্ধি পাবে । এ ব্যাপারে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে ।
৪.সুষ্ঠ খাদ্য নীতিঃ
সুষ্ঠ খাদ্য নীতির মাধ্যমে খাদ্য শস্যর মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় । এ উপায়ে দেশের খাদ্য শস্য সংগ্রহ ও বন্টন ব্যবস্থার আরো উন্নতি করা দরকার ।
৫. উৎপাদন বৃদ্ধিঃ
খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে হলে জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে । কৃষিতে বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় ।
৬.বন্যা নিয়ন্ত্রণঃ
কৃষি উন্নতি করতে হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ একান্ত আবশ্যক । এ উদ্দেশ্যে আমাদের দেশের নদীগুলো সংস্কার সাধন করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করতে হবে ।
৭.যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঃ
আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক বেশি পুরোনো । যোগাযোগে আমাদের অনেক সময় খাদ্য বা পন্য স্থানান্তরিত করতে গেলে সমস্যা দেখা দেয় । সুতরাং যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করা ছাড়া খাদ্য সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়
৮. অসাধু ব্যবসায়ীদের দমনঃ
মুনাফা শিকারী অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বে আইনী ভাবে খাদ্য শস্য গুদামজাত করতে না পারে । সেই দিকে সরকারের লক্ষ্য রাখতে হবে ।
৯. যৌথ খামারঃ
আমাদের দেশে কৃষিজাত গুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে বিভক্ত বলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় না । সমব্যয়ের মাধ্যমে যৌথ খামার সৃষ্টি করে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে চাষাবাদ করা সম্ভব ।
১০. উচ্চফলশীল জাতের শস্য উৎপাদনঃ
খাদ্য ঘাটতি দূর করতে হলে আমাদের কৃষিতে উচ্চফলশীল জাতের শস্য উৎপাদন করতে হবে । উচ্চফলশীল জাতের বীজ দ্বারা অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব ।
১১. জন্ম নিয়ন্ত্রনঃ
আমাদের দেশে জনসংখা বৃদ্ধির হার খাদ্য শস্য হার অপেক্ষা বেশি । এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জন্ম নিয়ন্ত্রন করতে হবে ।
১২. জলাবদ্ধতা দূরীকরণঃ
ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের হাওর এলাকাগুলোতে পাম্পের সাহায্যে পানি নিষ্কাশন করে ফসল ফলানো যেতে পারে ।
১৩. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনঃ
বাঙালী জাতি প্রধান খাদ্য হল ভাত । খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ভাতের সাথে আলু, গম,ভূট্টা ইত্যাদি খাবারের প্রতি আসক্ত করতে হবে ।
১৪. হিমাগার নির্মাণঃ
খাদ্য শস্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ করতে হবে । দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব হিমাগার কৃষি পন্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে ।
৭ম অধ্যায়
সুপারিশঃ
বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব । তবে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছুর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । নি¤েœ দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার জন্য যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত আমি তার কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।
১. উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি বা তৈরী করতে হবে ।
২. কৃষির উপরে বিভিন্ন গবেষণা মূলক প্রকল্প হাতে নিতে হবে ।
৩. সরকারীভাবে কৃষি ঋণদান কর্মসূচি ব্যাপক ভাবে উদ্দ্যেগ নিতে হবে ।
৪. কৃষি কাজে শিক্ষিত লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে ।
৫. কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান করা যেতে পারে ।
৬. বিদেশ থেকে খাদ্য পন্য আমদানি করা যেতে পারে ।
৭. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে । কেননা দেশ অস্থিতিশীল থাকলে কৃষক পন্য বা খাদ্য উৎপন্ন করে যথাযথ মূল্য পায় না ।
তাই সে খাদ্য সংকট দূর করার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকতে হবে ।
৮. সঠিক সময়ে খাদ্য গুদামজাত করতে হবে । এবং প্রয়োজনে তার ব্যবহার করতে হবে ।
৯. কৃষি কাজে পানির সেচ প্রকল্প আরো জড়ালো ভাবে বাড়িয়ে দিতে হবে ।
১০. সেসব স্থানে যাতাযাত ব্যবস্থা দূর্বল সেসব স্থানে সড়ক নির্মান
করতে হবে ।
১১. কৃষির উপরে শিক্ষার্থীদের বাস্তব ভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে ।
১২. সরকারী উদ্দ্যেগে কৃষির উপকরণ প্রদান করতে হবে । এতে কৃষকের অর্থ খরচ হ্রাস পাবে । ফলে কৃষক অন্য খাতে বেশি বিনিয়োগ করে অধিক ফসল উৎপন্ন করতে পারে ।
উপসংহারঃ
বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য সংকট একদিনে দেখা দেয় নি । এটি অনেক আগ থেকেই থেকেই আমাদের রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে । বর্তমানে এটি আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে । কারণ দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও জমির পরিমান একই আছে ।
পরিশেষে বলা যায় যে,
বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য সংকট আমাদের অর্থনীতির জন্য রীতিমত হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে । সুতরাং খাদ্যে স্বয়ংসনম্পূর্ণতা অর্জন আমাদের অর্থনীতির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত । কারণ খাদ্যে স্বয়ংসনম্পূর্ণ না হয়ে আমাদের পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রাপথে অগ্রসর হওয়া কঠিন ।