দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল-পার্ট-২
- 27-Mar-2022 08:52AM
- Zahidul Islam
- 1188
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণঃ-
দারিদ্র্যে অবশ্যই একটি আপেক্ষিক ব্যাপার । বাংলাদেশ সহ এ মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশই এর অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের বহু কারণ রয়েছে । তার প্রধান প্রধান কারণ গুলো আলোচনা করা হলো ঃ-
অনুন্নত শিক্ষা ব্যবস্থাঃ-
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতায় দেশের শাসনভার গেল নব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে । তারা ২৫ বছর শাসন শোষণ করল অপ্রতিহত গতিতে । শোষন করে দেশটাকে একেবারেই খালি করে দিল । ফলে কোন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি ।
এছাড়া বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি । দেশ আজ ৪২ বছর আগে স্বাধীন হয়েছে । তবুও দারিদ্র্যতা তার দুষ্টু চক্রের কবলে পড়ে শিল্পায়নকে অনগ্রসর করে রেখেছে ।
নিরক্ষরতাঃ-
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড । শিক্ষিত জনগন দেশের সম্পদ । শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির উন্নতি করা সম্ভব নয় । আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর । অল্পসংখ্যক মানুষই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পেরেছে । এর কারণ হলো দারিদ্র্যতা । কারণ অনেক ছোট থেকেই এদেশের শিশুদের অর্থ উপার্জনের কাজে লাগতে হয় । এছাড়া অনেক অভিভাবকদের শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে উদাসীন মনোভাব পরিলক্ষিত দেখা দেয় । এর ফলে তারা নিরক্ষর হিসেবে বড় হয় ।
প্রাকৃতিক দূর্যোগঃ-
এদেশের ভৌগোলিক অবস্থাই এমন যে প্রাকৃতিক দূর্যোগ এদেশের মানুষের নিত্য সহচর । প্রাকৃতিক দূর্যোগকে সঙ্গে নিয়েই এদেশের মানুষের বসবাস । প্রতি বছর অতি বৃষ্টি অনাবৃষ্টি ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙ্গন প্রভৃতি প্রাকৃতিক দূর্যোগে এদেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংশপ্রাপ্ত হচ্ছে । মানুষ হচ্ছে নিঃস্ব । হাজার হাজার মানুষের প্রাণ সংহারের সাথে সাথে জাতিকে বা দেশকে সমস্ত প্রাকৃতিক দূর্যোগ দারিদ্র্য ও নিঃস্বতার অভিশাপ উপহার দিচ্ছে ।
অধিক জনসংখ্যাঃ-
দেশের মোট সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক হলে দারিদ্র্য সেখানে হানা দিবেই । অর্থাৎ অধিক জনসংখ্যাই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ । মানুষ যতটুকু উৎপাদন করছে,
কিন্তু পারিবারিক প্রয়োজন এতই বেশি হচ্ছে যে তাতে কুলানো যাচ্ছে না । ফলে দিন দিন দারিদ্র্য বেড়েই চলেছে । খাদ্য সংকট নিত্যদিনের সাথী হয়ে বেকারত্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছে ।
দারিদ্র্য বিমোচন ঃ-
একথা অনস্বীকার্য যে দারিদ্র্য একটি বিরাট সমস্যা । দারিদ্র্য একটি দেশকে একটি জাতিকে পঙ্গু করে দেয় এহেন সমস্যাকে মুকাবিলা করতে প্রাথমিক ভাবে যে কারণটি আমাদের সামনে আসে সেটি হল অধিক জনসংখ্যা ।
দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় হিসেবে অধিক জনসংখ্যা রোধ করতে হবে । এজন্য পরিকল্পিত উপায়ে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে । বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে তা সর্বস্তরে চালু করতে হবে ।
দেশের আপামর জনসাধারণকে সচেতন করে বিশেষ করে নিরক্ষর ও স্বল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষতিকর দিকটিকে সামনে আনতে হবে ।
এবং পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বূদ্ধ করতে হবে ।
দারিদ্র্য বিমোচনের উপায়ঃ
আজ এ কথা সর্ব স্বীকৃত যে বিপুল জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য সীমার নিচে রেখে শুধু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যায় না । উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য বিমোচন প্রয়োজন ।
অতএব দারিদ্র্য বিমোচন কারী উন্নয়ন কৌশল বলতে ( ঢ়ড়াবৎঃু মৎড়ঃিয ংঃৎধঃবমু ) সঠিক ভাবে প্রণয়ন করা বাংলাদেশের জন্য আবশ্যক । দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল বলতে ঐ পদ্ধতি ও কর্মসূচিকে বুঝায় যা অবলম্বন করলে দ্রুত জনগন দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে ।
দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল ও কর্মসূচির প্রকৃতিঃ-
( ঢ়ড়াবৎঃু ধষষবারধঃরঢ়ড়হ ংুংঃবস ধহফ ঢ়ড়ষরপু : ফরৎবপঃ ধহফ রহফরৎবপঃ ঢ়ড়ষরপরবং): দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল ও কর্মসূচির পদ্ধতি কে দুই ভাগে ভাগ করা যায় ।
যথা ঃ- (১) প্রত্যক্ষ পদ্ধতি
(২) পরোক্ষ পদ্ধতি
(১) প্রত্যক্ষ পদ্ধতি ঃ-
প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে সরাসরি সাহায্য না করে বিভিন্ন আর্থ সামাজিক আয় কাঠামোর উন্নয়ন ঘটানো হয় । যাতে করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের অবস্থার উন্নয়নে নিজেরাই সক্ষম হয় । যেমন যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন । শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন ইত্যাদি ।
(২) পরোক্ষ পদ্ধতিঃ-
পরোক্ষ পদ্ধতিতে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে সরাসরি সাহায্য করে । বিভিন্ন আর্থ সামাজিক আয় কাঠামোর উন্নয়ন ঘটানো হয় । যাতে করে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী তাদের অবস্থার উন্নয়নে নিজেরাই সক্ষম হয় । তাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে দেওয়া হয় ।
এ উভয় পদ্ধতির কর্মসূচি গুলো প্রয়োগ করে দেশের সরকার বা সরকার নির্ধরিত প্রতিষ্ঠান । মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগনের আয় বা ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির দ্বারা দারিদ্র্য বিমোচন করা। আর এ সমস্ত কর্মসূচি বা সরকারী নীতিগুলোকে বলা হয় দারিদ্র্য বিমোচন নীতি ।
একটি রিগ্রেশন করে দেখানো হয়েছে যে এউচ এর প্রবৃদ্ধির হার যদি ১% বাড়ে তবে দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানরত মানুষের সংখ্যা .০৯% কমবে । সাম্প্রতিক সময়ে ইন্দোনেশিয়া ,
মালোয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে দেখা গেছে প্রায় ৭-৮% প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করার ফলে তাদের দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে । কারণ প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়া দারদ্র্যি ও অসুবিধাগ্রস্থ জনগোষ্ঠীকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে ।
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের ভূমিকা ঃ-
দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সাউথ সাউথ সম্মান দেওয়া হয় । তিনি নিউইয়কে ইন্টারন্যাসনাল অর্গানাইজেসন ফর সাউথ সাউথ কোঅপারেশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয় । বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের অনন্য অবদান
রাখায় জাতিসংঘ থেকে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে । সরকারের ভূমিকার পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও ব্যাক্তিগত ভাবে অনেকেই দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা পালন করছে ।
দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিওর ভূমিকাঃ-
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের পাশাপাশি এনজিওর ভূমিকা ও উদ্দ্যেগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ । দারিদ্র্যে বৈষম্য, নির্যাতন অবসানের লক্ষ্যে বিভিন্ন এনজিও এবং নারীবাদী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে । বাংলাদেশের এনজিও দের শীর্ষ সংগঠন হলো এডাপ । নি¤েœ তাদের কার্যক্রম তুলে ধরা হলো ঃ-
এক. ঋণ ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্যদের আয় বৃদ্ধিমূলক কাজ ।
দুই. আইনগত শিক্ষা ও সহায়তা । নির্যাতিত দারিদ্রদের আশ্রয় ও পূর্ণবাসন ।
তিন. মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে গতিশীলতা বাড়ানো ।
চার. জীবিকা নির্বাহের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ ।
পাঁচ. দারিদ্রদের স্বাস্থ্য খাদ্য, পুষ্টি এবং শিশু পরিচর্যার বিষয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা ।
ছয়. নারী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ।
সাত. জেন্ডার সমতায়ন ও টেকসই দারিদ্র্যে দূরিকরণ ।
আট. অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রচার,জনমতগঠন,সমাবেশ আন্দোলন পরিচালনা করা ।
নয়. এনজিওর নেতৃত্বে তৃণমূল পর্যায়ে দারিদ্রেদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা ।
দশ. এনজিও গুলো দারিদ্র্যের টার্গেট গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন কর্মসূচি ও উদ্দ্যেগ গ্রহণ করে ।
হাইমচর ব্যুরোঃ-
দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব দূরিকরণে হাইমচর ঋণ সেবার মাধ্যমে অসহায় পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুড়িয়ে দিতে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে ।
“দারিদ্র্য বিমোচন অঙ্গীকার,
একটি বাড়ি একটি খামার” ।
যার সূচনা ২০১০ সালে হয় । সরকার গরু,ছাগল দিয়ে সহায়তা করে থাকে এই প্রকল্পে । তবে সরকারের লোকবলের অভাবে এটি তেমন সাফলতা অর্জন করতে পারেনি । এই প্রকল্পের সমন্বয় করেন জিল্লুর রহমান । তাদের একটি প্রতিবেদনে জানা যায় তাদের কার্যক্রম ৬টি উপজেলায় ৫৯টি সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে ।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানঃ-
গ্রামীন ব্যাংক, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, প্রশিকা, আশা,শক্তি ফাউন্ডেশন,ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমবায় অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ইত্যাদি সহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে ।
ক্যালরী গ্রহণ ভিত্তিক দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হারের পরিবর্তন (শতকরা)ঃ-
নি¤েœ ক্যালরী গ্রহণ ভিত্তিক দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হারের পরিবর্তন একটি ছকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলোঃ-
দারিদ্র্যের প্রকৃতি
১৯৮৩-৮৪ ১৯৮৫-৮৬ ১৯৮৮-৮৯ ১৯৯১-৯২ ১৯৯৫-৯৬ ১৯৯৯-২০০০ ২০০৫-০৬
জাতীয় ৬২.৬ ৫৫.৭ ৪৭.৮ ৪৩.৫ ৪৭.৫ ৪৪.৩ ৪০.৪
পল্লী ৬১.৯ ৫৪.৭ ৪৭.৮ ৪৭.৬ ৪৭.১ ৪২.৩০ ৩৯.৫
শহর ৬৭.৮ ৬২.৬ ৪৭.৬ ৪৬.৭ ৪৯.৭ ৫২.৫০ ৪৩.২
জাতীয় ৩৬.৮৫ ২৬.৯ ২৮.৪ ২৮.০ ২৫.১ ২০.০ ১৯.৫
পল্লী ৩৬.৭ ২৬.৩ ২৮.৬ ২৮.৩ ২৪.৬ ১৮.৮০ ১৭.৯
শহর ৩৭.৪ ৩০.৭ ২৬.৪ ২৬.৩ ২৭.৩ ২৫.০০ ২৪.৫
উৎসঃ- বিবি এস খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০০৫, অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৭ এবং২০১০ পৃ ১৪৮ ও ১৮৩ ।
দারিদ্র্য বিমোচনে আমার সুপারিশঃ-
দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নিচের বিষয় গুলি বিবেচনা করা উচিত ঃ-
১. সকলের জন্য প্রাইমারী শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে ।
২. কিছু শাখা তৈরী করতে হবে যাতে গরীব লোকজন তাদের অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে ।
৩. কিছু দারিদ্র্য লোকের আতেœাকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে ।
৪. দারিদ্র্যদের জন্য কম সুদে ঋণ দিতে হবে ।
৫. দারিদ্র্য জনগণের আতেœাকর্মসংস্থানের শুরুতে উৎসাহ প্রদান করতে হবে । যাতে তারা কর্ম বিমুখ না হয় ।
৬. তাদের ঋণ পরিশোধ করার পদ্ধতি সংগতি পূর্ণ করতে হবে ।
৭. পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের ও প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে ।
৮. সমাজের বিত্তবানদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
৯. গ্রামীন অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে ।
১০. সমাজের সর্ব স্তরের লোকদের দারিদ্র্যতার কারণ ও কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে ।